এই ‘আমিত্ব’ কোন্টি—তাহা দেখিতে চাই।
যখন মানুষ অতীত-ভবিষ্যতের চিন্তা ত্যাগ করিতে
পারে, যখন সে দেহকে সীমাবদ্ধ—সুতরাং উৎপত্তি-বিনাশশীল জানিয়া দেহাভিমান ত্যাগ করিতে পারে, তখনই সে এক উচ্চতর অবস্থায় উপনীত হয়। দেহ আত্মা নয়, মনও আত্মা নয়, কারণ উহাদের হ্রাসবৃদ্ধি আছে। জড় জগতের অতীত আত্মাই অনন্তকাল ধরিয়া থাকিতে
পারেন। শরীর ও মন প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল—এগুলি পরিবর্তনশীল ঘটনা শ্রেণীর।
নামমাত্র; নদীর প্রত্যেক জলবিন্দুই নিয়ত-পরিবর্তনশীল প্রবাহের অন্তর্গত; তথাপি আমরা দেখিতেছি, উহা সেই একই নদী। এই দেহের প্রত্যেক পরমাণুই নিয়ত-পরিবর্তনশীল; কোন ব্যক্তির শরীরই কয়েক মুহূর্তের জন্যও একইরূপ থাকে না। তথাপি মনের একপ্রকার
সংস্কারবশতঃ আমরা উহাকে সেই এক শরীর বলিয়াই মনে করি। মন সম্বন্ধেও এইরূপ; উহা ক্ষণে সুখী, ক্ষণে দুঃখী, ক্ষণে সবল, ক্ষণে দুর্বল। নিয়ত-পরিবর্তনশীল ঘূর্ণিবিশেষ। সুতরাং উহাও আত্মা হইতে পারে না, আত্মা অনন্ত। পরিবর্তন কেবল সসীম বস্তুতেই সম্ভব। অনন্তের কোনরূপ পরিবর্তন
হওয়া অসম্ভব কথা। তাহা কখনও হইতে পারে না। শরীর-হিসাবে তুমি আমি এক স্থান হইতে
স্থানান্তরে যাইতে পারি, জগতের প্রত্যেক অণুপরমাণুই সদা-পরিবর্তনশীল; কিন্তু জগৎকে সমষ্টিরূপে ধরিলে
উহাতে গতি বা পরিবর্তন অসম্ভব। গতি সর্বত্রই আপেক্ষিক। তুমি বা আমি যখন এক স্থান হইতে
অন্য স্থানে যাই, তাহা অপর একটি স্থির বস্তুর সহিত তুলনায় বুঝিতে হইবে; জগতের কোন পরমাণু অপর একটি পরমাণুর সহিত তুলনায় পরিবর্তিত হইতে পারে, কিন্তু সমুদয় জগৎকে সমষ্টিভাবে ধরিলে কাহার সহিত তুলনায় উহা স্থান পরিবর্তন
করিবে? ঐ সমষ্টির অতিরিক্ত তো আর কিছু নাই। অতএব এই অনন্ত ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ অপরিণামী অচল ও পূর্ণ, উহাই পারমার্থিক সত্তা মানুষের যথার্থ স্বরূপ। সুতরাং সর্বব্যাপী অনন্তই সত্য, সান্ত সসীম সত্য নয়। আমরা ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ জীব—এই ধারণাটি যতই আরামপ্রদ হউক না
কেন, ইহা পুরাতন ভ্রম মাত্র। যদি লোককে বলা যায়, তুমি সর্বব্যাপী অনন্ত পুরুষ, সে ভয় পায়। সকলের ভিতর দিয়া তুমি কাজ করিতেছ, সকলের চরণের দ্বারা তুমি চলিতেছ, সকল মুখের দ্বারা তুমি কথা কহিতেছ, সকল নাসিকা দ্বারাই তুমি
শ্বাসপ্রশ্বাস-কার্য নির্বাহ করিতেছ, লোককে ইহা বলিলে সে ভয় পায়। সে তোমায়
পুনঃ পুনঃ জিজ্ঞাসা করিবে, ‘আমার এই আমিত্ব বজায় থাকিবে কি না?’ লোকের এই ‘আমিত্ব’ কোন্টি—তাহা দেখিতে চাই।
ছোট শিশুর
গোঁফ নাই, বড় হইলে তাহার গোঁফ-দাড়ি হয়। যদি ‘আমিত্ব’ শরীরগত হয়, তবে তো বালকের ‘আমিত্ব’ নষ্ট হইয়া গেল। যদি ‘আমিত্ব’ শরীরগত হয়, তবে আমার একটি চোখ বা হাত নষ্ট হইলে ‘আমিত্ব’ও নষ্ট হইয়া গেল। মাতালের মদ ছাড়া উচিত নয়, তাহা হইলে তাহার ‘আমিত্ব’ যাইবে। চোরের সাধু হওয়া উচিত নয়, তাহা হইলে সে তাহার ‘আমিত্ব’ হারাইবে! অতএব কাহারও এই ভয়ে নিজ অভ্যাস ত্যাগ করা উচিত নয়। অনন্ত ব্যতীত আর ‘আমিত্ব’ কিছুতেই নাই। এই অনন্তেরই কেবল পরিবর্তন হয় না, আর সবই ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। ‘আমিত্ব’ স্মৃতিতেও নাই। ‘আমিত্ব’ যদি স্মৃতিতে থাকিত, তবে মস্তকে প্রবল আঘাত পাইয়া অতীত স্মৃতি লুপ্ত হইয়া গেলে আমার ‘আমিত্ব’ নষ্ট হইত, আমি একেবারে লোপ পাইতাম। ছেলেবেলায় দুই-তিন বৎসর আমার মনে নাই; যদি স্মৃতির উপর আমার অস্তিত্ব নির্ভর করে, তাহা হইলে ঐ দুই-তিন বৎসর আমার
অস্তিত্ব ছিল না—বলিতেই হইবে। তাহা হইলে আমার জীবনে যে-অংশ আমার মনে নাই, সেই সময়ে আমি জীবিত ছিলাম না, বলিতে হইবে।
0 Comments