আলো-হাওয়া-জল থাকলেই বিশাল মহীরুহের সৃষ্টি হয় না !
আকাশ ও পৃথিবীর নিজস্ব রূপ ছাড়াও অন্য রূপ আছে।
সেই রূপ মানুষের মনে। দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্যে যে-রূপ শিল্পীর কাছে ধরা পড়ে, কবির চোখে তা নগণ্য নয়; বরং তা অপরূপ করে তোলে ঐ আকাশ আর পৃথিবীকে, প্রতিভাবান মানুষ সম্পর্কেও একই
কথা। দেশ ও কালের পরিবর্তনে তাঁদের মূল্যায়ন আর পুনর্মূল্যায়ন তাঁদের সীমাহীন
ব্যক্তিত্বের নানান দিককে তুলে ধরে। এঁদের মূল সত্তার অন্বেষণে নতুন বিচার-শৈলী, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তন উত্তর পুরুষদের নিজস্ব প্রয়োজন। এ প্রয়োজন
ইতিহাসেরও যেহেতু এঁদের আবির্ভাব শুধু ঘটনা নয়, একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়। নরেন্দ্রনাথ
থেকে বিবেকানন্দ, এই উত্তরণ-পর্ব নিয়ে আলোচনা নতুন বিবেচনা নয়। ভগিনী নিবেদিতা থেকে শুরু করে
ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, ক্রিস্টোফার ঈশারহুড থেকে শংকরীপ্রসাদ বসু, অনেকেই এ নিয়ে ভেবেছেন, লিখেছেন দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে এঁদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে সে-সব
গবেষণা শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রভাব, ভারত প্রব্রজ্যার অভিজ্ঞতা, অগাধ পাণ্ডিত্য, সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রভাব ইত্যাদি নানান কারণে নরেন্দ্রনাথ বিবেকানন্দে
পরিণত হয়েছিলেন, এ কথা আমরা পাই পূর্ব-গবেষকদের লেখায়। একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। উপরোক্ত
প্রভাবগুলিই কি চূড়ান্ত ছিল? আবার শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রভাব
তৎকালীন বহু ব্রাহ্ম, খৃষ্টান ধর্মপ্রচারক এবং যুবকদের ওপরেও পড়েছিল; এ-প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন বহু
লোক-অভিনেতা, সমাজ সংস্কারকও। এ-সত্ত্বেও ‘বিবেকানন্দ’ হতে পেরেছিলেন একজনই। কিংবা ভারত-ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বা অবাধ পাণ্ডিত্য বা
সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার সাথে পরিচয়, এ সবে তৎকালীন যুগে স্বামী
একচেটিয়া অধিকার তো ছিল না! বরং ভারতীয় নবজাগরণের সেই মুহূর্তে উপরোক্ত গুণ
অনেকেরই ছিল। কিন্তু এ সত্ত্বেও সেই যুগে যেভাবে দু’হাতে ধরে ভারতের ঘুম ভাঙ্গিয়ে
দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনটি কারোর মধ্যে দেখা যায়নি। অতএব বলতেই হবে যে আরও কিছু ছিল যা
নরেন্দ্রনাথকে বিবেকানন্দে পরিণত করেছিল। পূর্ব গবেষণার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও বলা
যায়, এই রূপান্তর সাধনে নানান প্রভাবকে আবিষ্কার করার চেয়ে বড় কাজ মানুষ
বিবেকানন্দকে খুঁজে বের করা। আলো-হাওয়া-জল থাকলেই বিশাল মহীরুহের সৃষ্টি হয় না, তার জন্য দরকার সঠিক বীজ যার লুকিয়ে আছে মহীরুহের প্রাণবস্তুর সম্ভাবনা।
স্বামীজীর আবিষ্কার করতে গিয়ে এই মৌল সত্যটিকে ভুললে চলবে না। তাঁর মধ্যে এমন কিছু
ছিল যা পূর্বোল্লিখিত প্রভাবগুলির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সাথ দিয়েছিল মৌলিক চিন্তার
সাহায্যে। আর, এইটিকেই আমরা চিহ্নিত করতে পারি ‘মানুষ বিবেকানন্দ’ রূপে।
তরুণ
নরেন্দ্রনাথের মধ্যে আমরা যে বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্য করি তা হল সত্যানুসন্ধিৎসা।
ইতিহাস থেকে গণিত, সাহিত্য থেকে দর্শন, বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ পড়াশোনা তাঁর ছিল ঠিকই, কিন্তু নিছক পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি
এতে উদ্যোগী হননি। এনট্রান্সে প্রথম বিভাগে পাশ করলেও এফ-এ এবং বি-এ পরীক্ষায় তিনি
এতো ভাল ফল দেখাতে পারেন নি। তাঁর মতো একজন ছাত্র যাঁকে কলেজের প্রিন্সিপাল
উইলিয়াম হেস্টি জার্মান-বিশ্ব বিদ্যালয়গুলির দর্শনের ছাত্রদের চেয়েও বুদ্ধিমান বলে
অভিহিত করেছিলেন, দার্শনিক স্পেন্সার যাঁর যুক্তিবত্তায় মুগ্ধ হয়ে চিঠি দিয়েছিলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলিতে অনায়াসেই উচ্চস্থান অধিকার করতে পারেন নি
কেন? তার কারণ, নরেন্দ্রনাথ তখন মৌল সত্যের সন্ধানে অধীর। বইয়ের মধ্যে সেই সত্যের সন্ধানই
তিনি করতেন; কিছু না পেলে বইগুলি তাঁর মনে কোনও গভীর ছাপ রাখত না।
* স্বামী সোমেশ্বরানন্দের ‘লোকজীবনে শ্রীরামকৃষ্ণ’ থেকে *
0 Comments