বেদের তাৎপর্য যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে, তারই জন্যই কি মহাভারতের রচনা ?
পদ্ম পুরাণে রয়েছে যে, দ্বাপরের শেষে নানা অপসিদ্ধান্তের জন্য বেদের সারার্থ আচ্ছন্ন-প্রায় হয়ে গেলে, দেবতারা শ্রীনারায়ণের শরণাপন্ন হন। বেদমূর্তি শ্রীনারায়ণ তখন ব্যাসরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে চতুর্বেদ বিভাগ করেন। বেদবিভাগ করে ব্যাসদেব ভাবলেন যে, যারা যাগ-যজ্ঞ, পঠন-পাঠনে রত থাকবে, যারা নিষ্ঠাবান এবং মেধাবী, তারাই বেদের অর্থ অনুধাবন করে, বেদোক্ত কর্ম করে মুক্তিলাভ করবে। কিন্তু স্ত্রীলোক, শূদ্র ও পতিত অর্থাৎ যারা অল্পবুদ্ধি, যাদের পঠন পাঠন নিয়ে থাকার সময় ও যোগ্যতা নেই, বেদার্থ-জ্ঞান লাভের যারা উপযুক্ত হয়নি, তাদের উপায় কি হবে? তাই তিনি বেদের তত্ত্বসমূহকেই গল্প, উপদেশ, কাহিনী ইত্যাদির মধ্য দিয়ে মহাভারত এবং পুরাণ রচনার মাধ্যমে ব্যক্ত করলেন, যাতে পুরাণোক্ত তত্ত্বের উপলব্ধি করে সাধারণ মানুষও মায়ামোহ অতিক্রম করতে পারে।

ঋক্, যজুঃ, সাম ও অথর্ব—এই চার ভাগে বেদ বিভক্ত হলো এবং মহাভারতাদি ইতিহাস এবং স্কন্দ, পদ্ম প্রভৃতি পুরাণ পঞ্চম বেদ রূপে পরিগণিত হলো। উদ্দেশ্য এই যে, পুরাণ ও মহাভারতে যে সব গল্প, উপদেশ ও কাহিনী রয়েছে, তার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ বেদের তত্ত্বসমূহই উপলব্ধি করতে পারবে—মায়ামোহ অতিক্রম করে মানুষ মুক্তি লাভ করবে, ভক্তিলাভ করবে। তাছাড়া যারা বুদ্ধিমান, যুক্তিবাদী, তাদের পরতত্ত্ব বোঝাবার জন্য ব্যাসদেব যুক্তিতর্কের অবতারণা করে ব্রহ্মসূত্র রচনা করলেন। বেদ বিভাগ, পুরাণ, মহাভারত রচনা, ব্রহ্মসূত্রের প্রচার—এ সবেরই উদ্দেশ্য এক—বিষয়ে নিবৃত্তি, ভগবানে আসক্তি এবং মুক্তিলাভের প্রচেষ্টা। কিন্তু এত করেও মানুষের বিষয় ভোগের বাসনা দূর হলো না—ভক্তি, মুক্তির জন্য মানুষ সচেষ্ট হলো না। বেদের কাম্য কর্মের কথায় রয়েছে যে, যাগ যজ্ঞাদি কর্মের ফলে মানুষ স্বর্গে গিয়ে সুখ ভোগ করতে পারবে। বেদের নিবৃত্তি-মূলক কথা ভুলে মানুষ সেই স্বর্গাদি ভোগের দিকেই ঝুঁকে পড়ল। করিনু পিপ্পলীখণ্ড কফ নিবারিতে দ্বিগুণ বাড়িল কফ দেখিতে দেখিতে।। তাই ব্যাসদেব একদিন আপন মনে বসে ভাবছিলেন—বেদ বিভাগ, পুরাণ, মহাভারত এবং ব্রহ্মসূত্র রচনা করেও তো জীবের যথার্থ মঙ্গল হলো না—মানুষের মন নিবৃত্তির দিকে গেল না।
এখন উপায় কি হবে—জীবের কি গতি হবে? এই চিন্তায় অত্যন্ত ক্লিষ্ট হয়ে ব্যাসদেব যখন মনের দুঃখে সরস্বতী নদীর তীরে বসেছিলেন, সেই সময় দেবর্ষি নারদ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। নারদকে দেখে ব্যাসদেব সসম্ভ্রমে উঠে তাঁকে অভ্যর্থনা করে বসালেন। দেবর্ষি নারদ ও ব্রহ্মার্ষি ব্যাসদেবের মিলন অতি অদ্ভুত এবং এর ফল হলো সুদূরপ্রসারী। একজন ভক্তশ্রেষ্ঠ এবং আর একজন জ্ঞানিশ্রেষ্ঠ। ভক্ত-চূড়ামণি নারদ আসন গ্রহণ করলে পর জ্ঞানিশ্রেষ্ঠ ব্যাসদেব, অজ্ঞানীর মতো বিষণ্ণ বদনে নারদের সামনে বসলেন।
ব্যাসদেবের মুখে বিষাদের ছায়া দেখে নারদ ভাবলেন—ভগবানের এ কি অদ্ভুত লীলা! যিনি স্বয়ং জ্ঞানময়, তিনিই ব্যাসরূপে অবতীর্ণ হয়ে অজ্ঞানীর অভিনয় করে দেখাচ্ছেন যে, ভক্তিহীন জ্ঞানে পড়াশান্তি লাভ হয় না। নারদ তখন ব্যাস-দেবকে বললেন—তোমাকে আর কুশল প্রশ্ন কি জিজ্ঞাসা করব! তোমার আর অকুশল কি থাকতে পারে? ধর্মই জীবের একমাত্র জ্ঞাতব্য এবং তা তুমি ভালভাবেই জান। তোমার রচিত মহাভারত-ই তার প্রমাণ। অতি দুর্বোধ্য বেদের তাৎপর্য যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে, তারই জন্য তুমি মহাভারত রচনা করেছ।
স্বামী গীতানন্দের ‘ভাগবত-কথা’ থেকে
0 Comments