যতদিন বিষয়-বাসনা থাকবে, ততদিন ভগবানের দিকে মন যাবে না।


যতদিন বিষয়-বাসনা থাকবে, ততদিন ভগবানের দিকে মন যাবে না।

নারদ বলছেনবিচিত্র রস, ভাব, অলংকার-যুক্ত বাক্যও যদি গোবিন্দ-গুণ-বর্ণন-হীন হয়, তবে তা সাধু ব্যক্তিরা পছন্দ করেন না। কিন্তু অপশব্দের দ্বারা রচিত গোবিন্দ-কথাও ভক্তেরা আনন্দের সঙ্গে শ্রবণ, বর্ণন কীর্তন করে থাকেন; আর তাতেই জীবের সমস্ত পাপ দূর হয়। তাই বলছি:
হে মহাভাগ্যবান ব্যাসদেব, তুমি অমোঘদৃক্অর্থাৎ অব্যর্থ দৃষ্টি, তোমার জ্ঞান যথার্থ; তুমি শুচিশ্রবা অর্থাৎ প্রথিতযশা। জগতের জীবের ভব-বন্ধন মোচনে যদি যথার্থই তোমার অভিলাষে হয়ে থাকে, তবে সত্যরতোভগবানে রত এবং ধৃতব্রতদৃঢ়চিত্ত হয়ে, একাগ্রচিত্তে অচিন্ত্যশক্তিশালী শ্রীগোবিন্দের মধুর লীলাবলী বার বার স্মরণ কর। এইভাবে বার বার গোবিন্দলীলার ধ্যান করতে করতে তোমার মধ্যে গোবিন্দলীলার স্ফুরণ হবে; তখন তা বর্ণনা করলে জগতের কল্যাণ হবে। বহির্মুখ লোকেরা নানা কথা বলে, নানা কাজ করে; কিন্তু কিছুতেই চিত্তের স্থিরতা আনতে পারে না। সংসার-সমুদ্র পার হতে হলে, চিত্তের স্থিরতা লাভ করতে হলে শ্রীগোবিন্দ-কথার আশ্রয় ছাড়া তো আর কোন উপায় নেই। ব্যাসদেব, তুমি বিচক্ষণ ব্যক্তি। তুমি তো জান যতদিন বিষয়-বাসনা থাকবে, ততদিন ভগবানের দিকে মন যাবে না। তাই বলছি, তুমি মধুর গোবিন্দ-লীলা বর্ণনা কর। গোবিন্দ-লীলা শ্রুতি-সুখকর এবং হৃদয়ে আনন্দ এনে দেয়একাধারে ভোগ মোক্ষপ্রবৃত্তির আবরণে নিবৃত্তি। গোবিন্দ-লীলার আশ্রয় নেওয়া মাত্র জীবের বিষয় বাসনা দূর হয় এবং গোবিন্দ-সেবার লালসা জন্মে। পুত্রকামী ব্যক্তিকে পুত্রের আশা ছাড়তে বলার চেয়ে ভগবানকে পুত্ররূপে পাবার পথ দেখানেই তো ভাল ফল হবে। শ্রবণ-সুখলিপ্সু ব্যক্তিকে গোবিন্দ-গুণ কথা শোনালেই তার যথার্থ সুখ হবে এবং তার যথার্থ মঙ্গল করা হবে। তাই বলি, তুমি গোবিন্দ-লীলার ধ্যান কর এবং ধ্যান করতে করতে তোমার হৃদয়ে যে গোবিন্দ-লীলার স্ফূর্তি হবে, তাই বর্ণনা কর। সেই গোবিন্দ-লীলা পাঠ করে, সেই লীলা শ্রবণ করে লোকের যথার্থ কল্যাণ হবে, তাদের সর্বার্থ সিদ্ধ হবে।
দেবর্ষি নারদ চলে যাবার পর ব্যাসদেব, নারদের কথার সারবত্তা হৃদয়ঙ্গম করে শ্রীগোবিন্দের ধ্যানে নিরত হলেন। ধ্যান-যোগে তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর অংশমৎস্য, কুর্ম, বরাহ, নৃসিঙ্ঘ, বামন প্রভৃতি অবতারের যে সব লীলা দর্শন করলেন, তা- তিনি শ্রীমদ্ভাগবত-রূপে জগতে প্রচার করলেন। ব্যাসদেব সমাধিতে সমস্ত অনর্থদূরকারী অর্থাৎ সংসার-বাসনা ক্ষয়কারী ভক্তিযোগের জ্ঞান লাভ করলেন। তখন বিষয়ান্ধ জীবের কল্যাণের জন্য সাত্বত সংহিতাম্‌—শ্রীমদ্ভাগবত সংহিতা প্রণয়ন করলেন। কি রকম সেই ভাগবত সংহিতা? ভাগবত কোন রকমে একটুমাত্র শ্রবণ করলেই পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণে ভক্তিলাভ হয় এবং জীবের শোক, মোহ, ভয়, অর্থাৎ ভব-ভয় দূর হয়। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, ব্যাসদেবের হৃদয়াকাশে বিভাসিত শ্রীমদ্ভাগবত শ্রীভগবানেরই অশেষ করুণার দান।
ভাগবত রচনা করে ব্যাসদেব ভাবলেনএই অমৃত এখন কোন্পাত্রে রাখা হবেকার মাধ্যমেই বা এই অমৃত জগতে পরিবেশিত হবে? তখন অনেক ভেবে চিন্তে তিনি ঠিক করলেন যে, একমাত্র তাঁরই পুত্র শুকদেব, যিনি আজন্ম সংসার-ত্যাগী, ব্রহ্মধ্যানে সদা নিরত, একমাত্র সেই শুকদেবই এই অমৃত ধারণ করতে সক্ষমজগতে একমাত্র সে- যথার্থরূপে ভাগবতের প্রচার করতে পারবে। তাই তিনি শুকদেবকে আনিয়ে উপদেশ করলেন এই শ্রীমদ্ভাগবত


স্বামী গীতানন্দেরভাগবত-কথাথেকে


Post a Comment

0 Comments

Translate

close